শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৮ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বঙ্গবন্ধুর স্বাজাত্যবোধ ও বিশ্বসভায় বাংলাদেশ

এ কে এম শাহনাওয়াজ:

আমি বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব স্মরণ করে শোক ভুলতে চাই। আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা হয়নি। এ একদিকে ভালোই হয়েছে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক কলিংউড বহু আগেই বলেছিলেন ইতিহাস লিখবেন একজন পেশাদার ইতিহাসবিদ। আর লিখবেন ঘটনা ঘটে যাওয়ার দুই প্রজন্মের পরে। অর্থাৎ কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর পার হলে। তখন ইতিহাসকে প্রভাবিত করার মতো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সক্রিয় থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সময় থেকে গুনলে এখনো কিছুটা বাকি। কলিংউডের আশঙ্কার মতো আমরা আশঙ্কার সঙ্গে দেখছি অন্য কাউকে জোরপূর্বক উজ্জ্বল করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বের ঔজ্জ্বল্য ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। এতে নতুন প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তা চলে যাচ্ছে বলে আমরা শঙ্কা প্রকাশ করছি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকৃত গবেষণা হলে অনেক সত্য সামনে চলে আসবে। এতে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত স্বরূপ যেমন প্রজন্মের সামনে চলে আসবে, তেমনি মনগড়া ইতিহাসও কালের গর্ভে নিক্ষিপ্ত হবে।

আজকের লেখায় বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বের একটি কম আলোচিত বিষয়কে উপস্থাপনের চেষ্টা করব। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক অনন্য গৌরবের দিন। এদিন প্রথমবারের মতো একজন বাঙালি নেতা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে গৌরবের শিখরে তুলেছিলেন। বাংলা ভাষায় দেওয়া এই বক্তৃতা বঙ্গবন্ধুর বুকে লালন করা স্বাজাত্যবোধেরই প্রকাশ।

বক্তৃতাটিতে তার দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের গভীরতা উন্মোচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে শুধু সফল রাজনৈতিক নেতাই নন, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তার যে শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ রয়েছে সে সত্যটিও প্রকাশিত হয়েছে এই বক্তৃতার ভেতর। শুধু স্বদেশপ্রীতিই নয়, বিশ্বমানবতার প্রতি তার যে আবেগ এবং দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সহজাত প্রবণতা, এর প্রকাশও স্পষ্ট হয়েছে এই মহান নেতার উপস্থাপিত ভাষণে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে স্বদেশে ফিরেছেন পাকিস্তানের মৃত্যুপুরী থেকে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ তার সামনে। দেশজুড়ে চলছে নানা অস্থিতিশীলতা। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগও সংকটের অনুঘটক হয়ে দেখা দিচ্ছিল। এমন সংকটেও বিশ্বরাজনীতির সামনে বিস্ময়কর সাফল্য স্থাপন করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই উপহার দিয়েছিলেন সংবিধান। হয়তো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নানা সংকট সামাল দিতে এই সংবিধান উপস্থাপনকে বঙ্গবন্ধু দূরদর্শিতার সঙ্গে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। দেশের এই বাস্তবতায় দু-এক বছরে একটি স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করা সুকঠিন। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এর মধ্যে ১৯৭৪-এ ভয়াবহ বন্যা বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পদক্ষেপকে অনেকটা শ্লথ করে দিয়েছিল। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। পরাজিত পাকিস্তানি আর তাদের দোসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শঠ নেতৃত্ব নিশ্চুপে বসে থাকেনি। তারা চেয়েছে এই নবীন রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে দিতে। এর প্রক্রিয়ায় দেশে একটি দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরি হতে থাকে।

এমন এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম সভায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা উপস্থাপন ছিল অভিনব। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে দৃঢ়তা থাকার কথা, স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপ্ত বঙ্গবন্ধুর ভেতর তা ছিল। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে রাখার ভাবনা এই মহান নেতার মধ্যে বরাবরই দেখতে পাই। তরুণ ছাত্র শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে রাজপথ প্রকম্পিত করেছেন। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে জেলে অন্তরীণ থাকলেও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ভূমিকা রেখে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লেও অনুভব করা যায় বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি প্রগাঢ় সম্মানবোধ তার ছিল। আমরা বরং আজ বিভ্রান্ত হচ্ছি প্রতিদিন। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রত্যুষে নগ্নপায়ে প্রভাতফেরিতে বঙ্গবন্ধুর শহীদ মিনারের যাওয়ার ছবি দেখলে বারবার মনে হয় বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকার খুব প্রয়োজন ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রধান আবেগই ছিল প্রভাতফেরিকে ঘিরে। আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বিশ্ববাসী পালন করে। স্বাভাবিকভাবেই সব দেশই ভাষা দিবসের উৎস ভূমিকেই অনুসরণ করতে চাইবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে কোনো এক সামরিক রাষ্ট্রনায়ককে অনুসরণ করতে গিয়ে প্রভাতফেরি বর্জন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে মধ্যরাতে একুশের ‘প্রথম প্রহর’ উদযাপন করি। এই ইতিহাস বিকৃত করা আয়োজনকে বিনা প্রতিবাদে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মীরাও মেনে নিয়েছি। এর পেছনে আমাদের স্বাজাত্যবোধের অভাবকেই দায়ী করতে হয়।

অথচ বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করে ভাষাশহীদদের রক্তের ঋণ যেমন শোধ করেছেন, তেমনি বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন সদ্য স্বাধীন হওয়া এ দেশটির গৌরবগাথা ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি অপূর্ণ দেশাত্মবোধের কারণে সংবিধানের বিধানকেও যেন অস্বীকার করা হচ্ছে। বাংলা ভাষা চর্চাকে পেছনে হটিয়ে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য মেনে নিতে চাইছে অনেকেই। গত তিন দশকের স্রোতে এখন ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ছড়াছড়ি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার মাধ্যম একমাত্র ভাষা ইংরেজি। আমার এই ভেবে ভয় হয় বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দিয়ে এগারো শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে আসা সেন বংশীয় রাজারা যেভাবে বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তিকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছিল। একই ছকে পাকিস্তানি শাসকরা চেয়েছিল বাঙালি প্রজন্মকে বাংলা ভুলিয়ে নিজেদের তাঁবেদার বানাতে। আর এখন পাশ্চাত্য শক্তি যারা নিজেদের সামরিক আর অর্থনৈতিক বলয় গড়ে তুলতে চায়, দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে ব্যবহার করতে চায়, তারাও চাইছে প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতি ভোলাতে। চারপাশে এমন আয়োজনই দেখতে পাচ্ছি।

এসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেওয়ার তাৎপর্য আরও বেশি গভীর হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নানা সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার গৌরবকে খাটো হতে দেননি। ২০১৬ সালে প্যারিস শহরে বসে এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে একবার বিশেষভাবে মনে পড়েছিল আমার। আপনারা জানেন, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোয় ইংরেজি ভাষা প্রায় অচল। আমার মতো বাঙালি, যাদের মাতৃভাষা ছাড়া একমাত্র ইংরেজি ভাষা জানা আছে, এসব দেশে তাদের ভারী বিপদ। ট্যাক্সি ড্রাইভার আর হোটেল ম্যানেজার ছাড়া ইংরেজি বলে সহযোগিতা করার মানুষের খুব অভাব। দোকানে খাবারের প্যাকেট থেকে শুরু করে দোকানের সাইনবোর্ড কোথাও ইংরেজি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন একটি অবস্থায় আমি বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে গিয়ে একটু বিরক্তই হলাম। পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জাদুঘর। সারা দুনিয়া থেকে লাখ লাখ দর্শনার্থী আসে এখানে। অথচ প্রতিটি প্রদর্শিত বস্তুর পরিচিতি লেখা আছে ফরাসি ভাষায়। ইংরেজির নামগন্ধ নেই।

রাতে হোটেল ম্যানেজার এক ফরাসি মঁসিয়েকে বললাম আমার অভিজ্ঞতার কথা। বললাম, তোমরা এত কনজারভেটিভ কেন! আন্তর্জাতিক ভাষা বলেও কি পাশাপাশি ইংরেজি রাখা যেত না? মঁসিয়ের উত্তরটি সারাজীবনের জন্য আমার মনে গাঁথা হয়ে গেল। তিনি বললেন, দেখো, আজ আমাদের তোমরা উন্নত দেশের মর্যাদা দিয়েছো। আমরা বিশ্বাস করি, এই উন্নতি এসেছে আমাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছি বলে। আজ আন্তর্জাতিক ভাষা বলে আমরা যদি ইংরেজিকে অবাধ প্রবেশের সুযোগ করে দিই, তবে দুর্বল হয়ে যাবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। এতে আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দূরদর্শী নেতা ভাষার শক্তিকে যেভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন, আমরা নীতিনির্ধারকরা তা বুঝতে ভুল করছি। তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ধারণ করতে না পারলে দেশের মর্যাদা যেমন বাড়ে না, তেমনি ব্যাহত হয় অগ্রগতির ধারা। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু তার লিখিত ভাষণে শুধু নিজ দেশের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকটের কথা তুলে ধরেছেন তেমন নয়। একজন যথার্থ বিশ্বনেতার মতো নিপীড়িত মানুষের বন্ধু হিসেবে তাদের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়াতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবার দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বিশ্বের সব মানুষের জন্য শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানান।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে তার ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন পথ ধরে পাওয়া নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের মর্যাদা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই ইতিহাসচর্চা বিচ্ছিন্ন আমাদের আত্মমর্যাদায় ফিরে আসতে হলে বঙ্গবন্ধুর স্বাজাত্যবোধের গভীরতা অনুধাবন করতে হবে।লেখক

অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION